রবিবার, ৩ জুন, ২০১২

হে আকাশ হে অরণ্য - আহসান হাবীব

হে আকাশ হে অরণ্য
তোমাদের মাঝখানে কতবার কত না প্রাচীর
বেঁধেছে হৃদয়;
তবু বারবার সমুদ্রের তীর
সহসা তরঙ্গ হানে
ছুঁয়ে যায় আকাশের কোণ,
আবার সে পুরনো স্বপন
ভাঙে সে প্রাচীর আর জাগায় বিস্ময়,
আবার সমুদ্রতীরে সেই ঝড় বয়।
সেই ঝড় দোলা দেয় অশোকের বনে!
সেই ঝড় ঝড় আনে গগন-গহনে!

সেই সব রাত আর সেই সব তারারা আবার
হাজার হাজার যুগ হ’য়ে যায় পার,
সেই সব পরীদের চোখ
আবার উজ্জ্বল হয়,
ঝরোকায় নতুন আলোক।
বিবসনা শা’জাদী ঘুমায়-
মনের কিনার ঘিরে সেইসব ঘোড়াদের পায়
পাহাড়ের তট ভাঙে
আর ভাঙে হৃদয়ের তীর,
আবার উধাও পাখা সেই সব পুরনো পাখির।
তারপর হে আকাশ হে অরণ্য
আবার বিরোধ,
আবার সীমান্ত ঘিরে সেই প্রতিরোধ
অরণ্যে আকাশে,
সমুদ্রের কালো জলে দিনগুলি ফেনা হ’য়ে ভাসে।
ভেসে যায় অরণ্য-কিনার।
খসে পড়ে সেই গ্রন্থি
ধ'সে পড়ে মনের মিনার।

তার চেয়ে হে আকাশ হে অরণ্য
সেইসব দিনের ছায়ারা
সেইসব মমীদের মলিন কায়ারা
এখানে ঘুমাক।
আমার হৃদয় থেকে সেইসব দিন মুছে যাক।
এখানে নামুক দিন
পাখা নেই যেসব দিনের,
এখানে নামুক রাত
যে রাতের ছায়াতলে স্বপ্ন নেই নীল কপোতের।
এখানে নামুক ছায়া
 যে ছায়ারা ঘর বেঁধে রয়,
এখানে নামুক ছায়া
যে ছায়ারা কায়াহীন নয়।

আজকের কবিতা - আহসান হাবীব

এখানে তোমার ছাউনি ফেলো না আজকে
     এটা বালুর চর:
চারদিকে এর কৌটিল্যের কন্টকময় বন ধূসর!
ঊর্ধ্বে আকাশ ম্লান মেঘের
নিম্নে অতল বন্যা এর-
বাস করে শত চানক্যশিশু শকুনির বহু বংশধর
এখানে তোমার ছাউনি ফেলো না এখানে বেঁধো না বিরাম ঘর।

পূবালী হাওয়ার নিশাস শুনছ?
             জ্বলবে না আজ গৃহের দীপ!
পায়ের তলায় শ্বাস ফেলে যায় হিংস্র কুটিল সরীসৃপ!
             বিংশ শতকী সভ্য দিন-
             শাণিত কৃপাণ শঙ্কাহীন
শস্যে হানবে শুনো ক্ষেতে তার হবে স্বার্থের হীন জরিপ
নীল রক্তের অভিশাপে ঘেরা জাগে নিপিষ্ট রিক্ত দ্বীপ।

তোমার আমার দিন ফুরায়েছে যুগটাই নাকি বৈপ্লবিক-
গানের পাখিরা নাম সই করে নীচে লিখে দেয় রাজনীতিক
            থাকতে কি চাও নির্বিরোধ?
           রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।
নীড় প্রলোভন নিরাপদ নয় বোমারু বিমান আকস্মিক
আরব্ধ গান এইখানে শেষ আজকে আহত সুরের পিক।

সপ্তসুরের উর্বশী তব আজি অথর্ব মৃত্তিকায়
কাঁদে মন্দার-গন্ধ-বিরহী বন্ধ্যাদিনের বন্দী বায়।
             ধুলায় ধূসর দীর্ঘ পথ
            হানছে কঠোর সুর শপথ
কল্প কামজ কুমারী কন্যা জ্বলে প্রচন্ড দিন শিখায়,
রমণীয় চাঁদ রাত্রির সুর মরেছে যাত্রা প্রান্তিকায়।

অদূর অতীত অখ্যাত দিনে যে সুর করেছে জন্মলাভ
সে জন্মপাপে আজকে জেগেছে আকুল আর্ত এই আবার
             হারানো সুরের কঙ্কালের
             দুঃসহ স্মৃতি তিক্ত জের
নির্বিকল্প কাল- প্রেক্ষায় আনে বিভ্রম বৈরিভাব,
অকাল-জন্ম ঋণ শোধ করে সৃজি সহস্র ঊর্ণনাভ।

আমাদের দিন মৃত্যু-তুহীন দীর্ঘায়ু হবে শ্যেনবিধান,
মৃৎ-পিপাসা ও শান্তিহরণ চিরদিন রবে বিদ্যমান।
          জঠরের জ্বালা চিরন্তন
          চির ক্লেদাক্ত এই জীবন
যুগ নিষাদের কপিশ নয়ন হানবে সেখানে দৃষ্টিবাণ।
আজকের দিনে এই ত কবিতা গানের পাখির এই ত গান।

আমি আছি - আহসান হাবীব

নক্ষত্র আঁধার আর এই ক্ষোভ হাহাস্বরে নেই
দক্ষিণ বাতাসে পাতা মন্দিরায় আমি নেই। আমি
প্রস্তরে ছিলাম। আমি ধাবমান প্রাচীণ হরিণ আর
      হিংস্র পশুর চোখে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ছিলাম, আমি
      নিয়ন্ত্রিত সাজানো আগুনে বৃত্তাকারে
      ছিলাম অপরাজেয় প্রতিদ্বন্দী স্মৃতিহরণের।

আমাকে পাবে না তুমি এই শুষ্ক তৃণদলে, তুমি
আমাকে পাবে না এই মৃত্তিকার গহ্বরে, কেননা
      আমি এই মৃত্যুকে লঙ্ঘন করি বারম্বার
      মৃত্যুকে লঙ্ঘন করে বহমান ইতিহাসে যাই
এবং নিজেকে আমি বারম্বার পার হয়ে ইতিহাসে লগ্ন হই
ব্যাপ্ত হই তোমাতে এবং তোমার স্বজনলোকে। আমি
তোমার অস্তিত্বে গাঁথা। খররৌদ্রে ঝড়ে ও বর্ষায়
আজন্ম তোমার সঙ্গী, আমি নই তুমিই আমার
প্রতিবিম্ব। আমি প্রস্তর অরণ্য আর ধাবমান হরিণের কাল
পার হয়ে অবিশ্রান্ত তোমাতে ধাবিত।

অরণ্য আমার নয়, নদী নয়, নক্ষত্রও নয়
তোমাকে দিয়েছি আমি আরণ্য অভীপ্সা আর দিয়েছি নদীর
প্রবহমানতা। এই ফুল নয়, পাখি নয়, চন্দ্রিমা আমার নয়, তবু
        ফুল আর পাখির উৎসব আমি দিয়েছি তোমাকে
               চন্দ্রিমার বিষাদ দিয়েছি।

আজন্ম তোমার সঙ্গী, স্বপ্নে আছি সংগ্রামেও আছি
আমি সঙ্গে থাকি তাই সঙ্গীত-সভায় বাজে করতালি
সঙ্গে থাকি সামনে থাকি তাই রুদ্ধ উৎসব তোরণ
                কেঁপে কেঁপে ওঠে।

ব্যাকুলতা আমাকে ছোঁবে না। আর্তিতে পাবে না।
তোমার ঘরেই দেখ কেমন বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ে আছি
        এবং আমার প্রতিদ্বন্দী তুমিই এ কথা
জেনে নিলে জানবে তুমি কে কোথায় আছি।

ফিরতে হবে - আহসান হাবীব

ফসল কুড়াতে হলে ফিরতে হবে এই পথে আসতেই হবে
মাছরাঙা বসিয়ে ডালে তুমি নীল মাছের আশায়
ইট কাঠ লোহা আর বারান্দার টবের উৎসবে
লীন হলে, জানবেই না কোথায় কখন চলে যায়
সাজানো নৌকার পাল, চলে যায় সারি গেয়ে দাড়ি
জানবে না কোথায় আছে তোমার আপন ঘাট আছে ঘরবাড়ি।

তোমার স্বজন আছে এই ব্যাপ্ত আদিগন্ত মাঠের মেলায়
ঘাটের কলসীতে আছে ঝলকিত পিপাসার জল
তুমি মেতে থাকলে দূর দ্বীপান্তরে নিঃসঙ্গ খেলায়
বেলা পড়ে যাবে। আর অবেলায় থাকে না ফসল।

ফসল তুলতে হলে ফিরতে হবে, এই পথে আসতেই হবে
অনেকেই জানতে চায় তুমি ঘরে ফিরে যাবে কবে,
জানতে চায় ঘরের মানুষ কেন বাইরে চলে যায়...
আমি কী উত্তর দেবো ? ওরা তবু আছে প্রতীক্ষায়!

যৌবনে জীবনে তুমি -আহসান হাবীব

তোমারই আভায় নিত্য নবরূপে তোমাকে দেখার
আকাংখার দীপ জ্বেলে হৃদয়ে
কৈশোর-যৌবনের সারাপথ হেঁটেছি,
জীবন আমার একার নয় জেনেছি
            এবং তোমাতেই সমর্পণ করেছি;
রেখেছি একাগ্র দৃষ্টির আলো পথে ফেলে
যে পথের ধুলি মেখেছি সর্বাঙ্গে
আর কারার নির্মম অন্ধকার উপেক্ষা করেছি
মুক্ত বুক সঙীনের মুখে পেতেছি নির্ভয়ে
শুধু এক অকৃত্রিম বাসনায়।
পলাশ বকুলে বিকশিত
সোঁদাল মাটির গন্ধে মর্মরিত
হলুদ ফুলের স্বচ্ছন্দ সহজ সমর্পণে
সজ্জিত চিত্রিত এক অকৃত্রিম প্রতিমার কামনায়
এ জীবন সমর্পিত ছিলো।

তোমাকে পেয়েছি অতঃপর অতি কাছে
বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে।
বহু রক্ত
    প্রিয়জন
        অতি প্রিয় জীবনের সব সুধা
        আর আনন্দের বিনিময়ে।
অথচ আশ্চর্য এই
জননীর সে মহিমা বিলিয়ে পুরনো সেই নাগরের পায়ে
নর্তকীর ভূমিকায় আজো তুমি
মগ্নচেতনার অন্ধকারে আবিষ্ট আত্মার বলি এক।

বলদর্পী  বণিকের মানদন্ড আনত।
তোমার সর্বাঙ্গে সে রেখে গেছে পীড়নের বহু ক্ষত
আরো জীবনের উদভ্রান্ত অশ্লীল বহু নিমিষের
ক্লান্ত মত্ততার জ্বালা।
সে জ্বালায় আজো তুমি জ্বলো!
তাই ঘরের সমস্ত মন দূরে বাইরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে
নিয়ত কাঞ্চনমূল্যে বেলোয়ারী  সম্ভারে
তোমার ঘর ভরে।
হৃততৃপ্তি আত্মার আবেগে কী মত্ততা!
আর সেই মত্ততার স্রোতে
কে নিত্য নতুন ঢেউ রেখে যায় জানো না

এবং তোমারই আভায় নিত্য নবরূপে তোমাকে দেখার
আমার আজন্ম তৃষা কেন কাঁদে তুমি তা জানো না।

কে নিত্য হরণ করে তোমার শ্যামল দেহলাবণ্য,
তোমার কুন্তলের কৃষ্ণাভা,
তোমার আত্মার উজ্জ্বল ভোর
কে নিত্য রঙিন মেঘে ঢেকে দেয়
            তুমি তা জানো না।

তুমি তা জানো না!
আমি জানি।
জানি তাই আকাঙ্খার দীপে
আত্মার সুধায় জ্বলে একটি শিখা অমর্ত্য আশায়
এবং প্রত্যহ
শিউলি কি বকুল কিম্বা পদ্মকলি ভোরের পাখিরা
যখন ডানার ঘুম ঝেড়ে আসে নিমন্ত্রণে
আমিও তখন
    তাকাই
তাকিয়ে দেখি একটি অমর আত্মা!
যদিও বিষণ্ন আর ভীরু
তবু অপার বিশ্বাসে তখন মিনতি রাখি আমিও
এবং বলি:
দেখো দেখো তোমার আত্মার অন্ধকারে
কে যেন হীরের কুচি ছড়িয়ে ছড়িয়ে
ডাকে শোনো!

আমার সন্তান

তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় !

সন্ধ্যা পড়ার ঘরে একা বসতে ভয় পেত। নিজেই নিজের
ছায়া দেখে কেঁপে উঠত। কনিষ্ঠকে সঙ্গী পেলে তবেই নির্ভয়ে
বসত সে পড়ার ঘরে।

আমার সন্তান
যে আমার হাতের মুঠোয়
হাত রেখে তবে
নিশ্চিন্তে এ-পাড়া
ও-পাড়া ঘুরেছে, গেছে মেলায়
এবং নানা প্রশ্নে
ব্যতিব্যস্ত করেছে আমাকে,
আজ
তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় !

কোথায় বেরিয়ে যায় একা একা ব্যস্ত পায়ে
একা একা
ক্লান্ত হয়ে ফেরে, তার
কোথায় কী কাজ, তার কেন ক্লান্তি?
যখন বাড়িতে
কেন সে দুধের সর না পেলেও এখন একবারও
ক্ষুব্ধ দৃষ্টি মেলে দিয়ে তাকায় না মার চোখে চোখে?
যা পায় তা খায় কেন মুখ বুজে
কেন সে হঠাৎ
এমন উৎকর্ণ হয়ে বাইরে চোখ ফেরায়। খোকন
কিছু যেন শুনতে চায়। ঘরে নয় বাইরে কিছু শুনবে বলে
কান পাতে। কখনো না খেয়ে
হঠাৎ বেরিয়ে যায়
কোথায়, কোথায়?

কী ভাবনায় আমার খোকন
দুদিনেই এমন গম্ভীর হয়ে গেল
এমন বিষণ্ন কেন
দীর্ণবুক দুঃখী মানুষের মতো হাঁটে কেন
এমন বয়স্ক কেন মনে হয় আমার খোকাকে।

কেন সে আমাকে
কিছুই বলে না আর
আমাকে আমার
পূর্বপুরুষের ছেঁড়া মাদুরে বসিয়ে রেখে অসহায়
হেঁটে যায় একাকী এমন রাজদর্পে
এবং তখন তার রাজবেশে আহা
সারা পথ এমন উজ্জ্বল হয়ে
জ্বলে ওঠে কেন।
আর তার কিশোর দেহের কী আশ্চর্য মহিমা। দু চোখে
প্রজ্ঞার আগুন যেন
কণ্ঠস্বর যেন
স্বর্গীয় সংকেতে ঋদ্ধ শব্দাবলী ছড়ায় দুপাশে।
দেখে দেখে মনে হয় কোনো নব পয়গম্বর যেন।

আমার সন্তান যায়
হেঁটে যায়
সামনে যায়
দেহ তার দীর্ঘতর হয়। আরো দীর্ঘ
সন্তানের দেহ
পিতার গর্বিত বুক উঁচু কাঁধ প্রশস্ত ললাট
ছাড়িয়ে সে আরো দীর্ঘতর হয়ে
আমার হাতের
নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে ছুটে যায়।

আসন্ন সন্ধ্যার
অন্ধকারে ভয় পেয়ে বুকফাটা চীৎকারে তখন
জানতে চাই, এই অন্ধকারে
কোথায় সে যেতে চায়, বলে
সামনে যাব।
সামনে কি ভয়াল অন্ধকার। বলে
অন্ধকার পেরোলেই আলো। বলি তাকে
ওপথে অনেক
হিংস্র জন্তুর তীক্ষ্ণ নখর তোমাকে চায়
উত্তরে খোকন
নীচু হাত ঊর্ধ্বে তুলে ঘোরায় তলোয়ার।

ওপথে নিশ্চিত মৃত্যু বলে আমি যখন আবার
অসহায় শিশুর মতোই কাঁদতে থাকি
তখন বয়স্ক কোনো পিতার কণ্ঠস্বরে খোকা বলে
‘মৃত্যুই জীবন’। এবং সে আরো বলে
তুমি আর হাতের আড়াল রেখো না আমার হাতে
ভয়ের কাফনে জড়িয়ে রেখো না আর
অন্ধকার ছড়িয়ে রেখো না,
আমার দু চোখে পিতা
তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার তাই
সামনে যাব
আরো সামনে
সূর্যোদয়ে যাব।

ইতিহাস আয়োজিত সাজানো মেলার
আলোয় দাঁড়াবো। বলে
যখন খোকন যায় আরো দূরে
যত দূরে আমার দুর্বল দৃষ্টি চলে না, তখন
কেঁদে বলি, তুই চলে গেলে
অন্ধকার অপমান নিঃসঙ্গতা এইসব রেখে
তুই চলে গেলে খোকা
আমার কী থাকে বল
আমার কী থাকে ! ব'লে
যখন কান্নায় ভেঙে পড়ি
হঠাৎ তখন
সন্তানের সেই দৃষ্টি ফেরায় আমার চোখে, বলে
‘পিতার গৌরব !’

দীপান্তর

অতঃপর সচকিত আকস্মিক বিমূঢ় বিরতি,
নিরাতঙ্ক পদতলে  এ-মৃত্তিকা বিশ্বাসঘাতক!
উড়ন্ত পাখায় আজ নেমে এল অবাঞ্ছিত যতি,
অরণ্য স্বপনহীন, বন্ধু আকাশ পলাতক!

দিনগুলি তারপর দুর্বোধ্য, ধোঁয়াটে, ধূসর,
সনির্বেদ, নিরালম্ব-অন্ধকার অচেনা বন্দরে
সশঙ্ক জিজ্ঞাসা লয়ে অবিরাম কাঁপে থরথর;
তীরবিদ্ধ দিনগুলি এ-মাটিতে চূর্ণ হয়ে ঝরে!

এ-দিন সে -দিন নয়-সুরভিত, হালকা কোমল;
এ-দিন সে-দিন নয়-শাদা রোদ, রঙিন পলাশ!
আজকের দিনগুলি ডানাভাঙা পাখি একদল,
এ-দিন মমতাহীন, দুর্বিষহ রূঢ় পরিহাস!

লাল মাটি, কালো পীচ্ শাদা নীল বালবের বুকে
ক্রুর  হাসি ফেঠে পড়ে, পরাক্রান্ত যুগের নিষাদ;
অক্লান্ত চাকার তলে বিস্মিত এ-নয়ন-সমুখে
দ্বীপান্তরে এ পৃথিবী অবিরাম করে আর্তনাদ!

প্রত্যয়ের দিন নাই , প্রতিশ্রুতি বিদ্রুপ-বিক্ষত
আশা ও আশ্বাস নাই, প্রেম হেথা স্বভাব বণিক;
নির্মাংশ অস্থির পাশে ভীড় করি কুকুরের মত,
দীর্ঘদিন বাঁচি মোরা জীবনেরে নিত্য দিয়া ধিক!


তোমার জন্যে

তোমার জন্যে এই আকাশের
গাঢ় নীলের প্রাচুর্য
আর সকাল বেলার শিশিরধোয়া
সবুজ ঘাসের স্পর্শটুকু
আর সময়ের সমুদ্রপার অলস-মধুর
মুক্ত করে রেখে যাবো,
সেই আশাতে-

তোমার জন্যে নির্ভাবনার
দিলগুলি আর
নিরুদ্বিগ্ন রাতের আকাশ,
আর তোমার এই এলোখোঁপায়
একটি অমর স্বপ্নশপথ রেখে যাবো,
সেই আশাতে-

ঝড়ের আকাশ শান্ত হবে
শান্তি পাবে,
তোমার মাটি তোমার জন্যে
 দেবে ফসল অফুরন্ত
মুক্ত হবে তোমার বাহু
আনবে ঘরে সোনাদানা
তোমার জন্যে;
দেখে যাবো তোমার শীর্ণ চোখের কোলে
আলোর বন্যা
নতুন দিনের আলোয় নেয়ে
শীর্ণ দেহ জাগবে আবার
নতুন জীবন
নতুন প্রেমে,
এই আশাতে-

এই আশাতে-
তোমার জন্যে গাঁথবো না আজ
কথার মালা,
মনে মনে তুলব না আর
অচেনা ফুল তোমার জন্যে;
আর তোমার ঐ চাঁদকপোলে
একটি কালো তিলের জন্যে
বোখারা আর সমরখন্দকে
বিলিয়ে দেবার দুঃসাহসও
করব না আর।
এবার থেকে
তোমার জন্যে কথা আমার দিনের আলোর
তপস্যাতে
ঝরবে পথে।

গড়বে নতুন দিনের বাসা
        মহৎ প্রেমে।
আমি তখন রই বা না রই
তুমি তখন
মুক্ত দিনের আলোর রাজ্যে রাণী হয়ো।

ক্রান্তিকাল


মধ্যরাতে রাজপথে দেখি এক নারীর শরীর-
যে নারী নায়িকা ছিলো কোনোকালে এই পৃথিবীর।

র্সবাঙ্গ পুড়েছে তার বণিকের তৃষ্ণার উত্তাপ,
হৃদয়ের রক্ত নিয়ে রেখে গেছে নখরের ছাপ ;
দেখে মনে হয়
বহুভোগ্যা এই নারী,
এ হৃদয় সে হৃদয় নয়।
একদিন এই নারী ইতিহাস-বিন্যাসের ভার
নিয়েছিল নিজ দেহে,
পৃথিবীর সঙ্গীত-সভার
যে নারী সম্রাজ্ঞী ছিলো,
অন্ধকার রাত্রির প্রহরে
 আজ দেখি সেই নারী রাজপথে আর্তনাদ করে।

কোথাও লাবণ্য নেই জেগে আছে ভয় ও বিস্ময়,
অভীপ্সার আলো থেকে বিচ্ছুরিত সে নারী এ নয়।

তনুর তনিমা ঘিরে আজ নেই হৃদয়ের ডাক
কুৎসিত কঙ্কাল ঘিরে ইতিহাস-নগরী নির্বাক।
আসমুদ্র আকাশের একাগ্র প্রেমের পরিণতি
এক সুরে উৎসারিত পৃথিবীর প্রথম প্রণতি
ব্যর্থ আজ।
লালসার পাশব লুন্ঠন
ঘটে গেছে। অতঃপর এই নারী খুলেছে গুন্ঠন
জনহীন রাজপথে অন্ধকারে ক্লান্ত দুই হাতে
আর তার সাথে
সভ্যতা-নারীর হাটে দেখি শত আকুঞ্চিত ভাল
ভয়ে ভীত শত শত সভ্যতার চতুর দালাল।

ক্ষমাই প্রার্থনা

আজন্ম সঞ্চিত ঋৃদ্ধ শব্দাবলী কথামালা
কবিতার সে সমৃদ্ধ কারুকাজ, আজ
আমাকে এমন করে করবে প্রতারণা
স্বপ্নে ভাবিনি।
কোনোদিন ভাবতেই পারিনি
শৈশব কৈশোর আর যৌবনে লালিত
উপমা প্রতীক ছবি
সব একে একে ভুলে যাবো
এবং এমন এক বোবা অন্ধকারে
ডুবে যাবো কোনদিন
কখনো ভাবিনি।

কখনো ভাবিনি আমি
একদা এমন এক অক্ষমতা
অস্থির ব্যাকুল করে তুলবে প্রাণ
কথার নদীর মরা বুকে
শুধু বুক জ্বলবে, আর
নতমুখে অপরাধী
আমাকে দাঁড়াতে হবে
মঞ্চভস্ম বুক নিয়ে, শব্দের কাঙাল।

মুহূর্তে নিজেকে আমি সঁপে দিয়ে ঝড়ের থাবায়
ছিন্নভিন্ন হয়েছি এবং বুঝতে চেয়েছি কিছু
কিছুই বুঝিনি।
উন্মত্ত ঢেউয়ের বুকে যতক্ষণ সম্ভব সাঁতার কেটেছি
মনে মনে
অবশেষে হাতের শিথিল কব্জি থেকে
খসে গেছে বুকের দুলাল
তবুও বুঝিনি, আহা বুকের দুলাল যার গেছে
তার ব্যথা।

কন্ঠলগ্ন প্রেয়সীকে ঢেউয়ের পাহাড়ে
আছড়ে আছড়ে যতবার কাঁদতে চেয়েছি, ততবার
সামনে খাড়া সুস্থির বনানী আর শুভ্র রোদ
আমার দু’চোখ
জ্বালিয়েছে
আরো বোবা অন্ধকারে নিয়ে গেছে ঠেলে।

ভাবতে চেয়েছি আমি
ভাই গেলো বোন গেলো ভেসে,
বৃদ্ধ পিতা রুগ্ন মা আমার
আমার একান্ত নিরাপদ জীবনের কামনাতে
নিয়োজিত সর্বশেষ মুহুর্ত বিলিয়ে
ভেসে ভেসে চলে গেল মৃত্যুর অতলে।
তবুও পারিনি হতে
সেই ভাই,
প্রলয়ের অন্ধকারে হঠাৎ  হারিয়ে যাওয়া ভাই-এর বোন-এর।
পারিনি সন্তান হতে সেই বৃদ্ধ পিতা কিংবা রুগ্না মার যার
সর্বশেষ নিঃশ্বাসেও উচ্চারিত রেখেছিল
আমার জীবন আর কল্যাণ কামনা।

সব স্বজনের শব সামনে নিয়ে যে বৃদ্ধ অথবা
যে কিশোর
দাঁড়িয়ে ভয়াল সেই মৃত জনপদে
আমি তার দু’চোখের জলে
ভাসতে চেয়েছি যতবার
ততবার নিজেকে সৌখিন এক অভিনেতা ভেবে
নিজের লজ্জায় নিজে কেঁদেছি
এবং বুঝেছি নিশ্চিত
কল্পনার অতীত যা তাকে
কল্পনায় নিয়ে আসা
কখনো সম্ভব নয়, শুধু
ঘটনাই ঘটনার সাক্ষী হতে পারে।

এই আর্তস্বর আর এই হাহাকারের শিকার
শব্দের কাঙাল আমি
কেবল নীরবে
একান্তে দাঁড়াতে পারি
এবং জানাতে পারি
আমার এ অক্ষমতা,
ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারি
মৃত আর মৃতপ্রায়
এই সব মথিত আত্মার কাছে
গলিত শবের
পবিত্র দুর্গন্ধ কিছু গায়ে মেখে
রুগ্ন এ আত্মার শুশ্রুষায় রত হতে পারি।

সে আসে

টলমল পদভারে সে আসে সে আসে।
বিপুল দানবদেহ
বজ্রনাদ!
মাটি কাঁপে
মাটির মানুষ কাঁপে আতঙ্কে দু’ধারে।
তার মুখে সম্রাটের হাসি।

সম্রাটের হাসি তার
এবং নির্ভীক
পদপাতে ঘাস ফুল সরোবর বাগান নিশ্চিহ্ন, তার
দৃষ্টি উর্ধ্বে;
মানব-মনীষা
সে তার দৃষ্টির তাপে উজ্জীবিত করে যায় যেন।

এবং জীবন্মৃত মানুষের ভীড়ে
আতঙ্কে ধ্বনি ওঠে যখন, সে হাসে
সম্রাটের করুণায় এবং দু’হাতে
কর্কশ দু’হাতে তার অন্নের আশ্বাস
আর বরাভয় ছড়িয়ে ছড়িয়ে
পথের দু’ধারে তার রেখে যায় অপার বিস্ময়,
জয়ধ্বনি।

কি তার বিপুল দেহ
ইটের উপরে ইট
সূর্যের সমস্ত মুখ ঢেকে যায়
লোহায়-বিদ্যুতে প্রস্তরখিলানে গড়া
এবং সে আসে
নির্ভীক নিশ্চিত পায়ে
নিশ্চিত আশ্বাস
জয় তার।

দেশ থেকে দেশান্তরে গতি তার অব্যাহত সম্রাটের মত।
পৃথিবীর মানবসমাজ
আজ তার শাসনের অনুগত
        কিঙ্করের মত
নিত্য তাকে অনুসরণেই
        সুখের সন্ধান করে-
এবং একজন পলাতক এই মত্ত ভীড়ের পশ্চাতে
খুঁজে ফেরে হারানো বাগান
সরোবর ঘাস ফুল।
ক্ষুধার অন্নের বিনিময়ে
এই সব নিঃশেষে হারাতে নয় রাজি
তাই জেনে
কেউ মূর্খ কেউ বলে উন্মাদ। সে বলে:
এই মত্ত গতির কোথায় শেষ জানা নেই,
জানে না সম্রাট নিজে
আর তার অগণিত প্রজাদের জানা নেই।
তাই
চায় না বিচ্ছিন্ন হতে মাটি থেকে
সে চায় নতুন কোনো সন্ধি। তার
শর্ত রচনার ভার কে নেবে জানে না,
সে চায় নতুন কোনো আশ্বাসের বাণী।

প্রদক্ষিণ

ক্ষণিকের সূর্য নয় মনের মিনারে
সমুদ্রের স্বাদ নয় আত্মার কিনারে
এখানে সমুদ্র ছিলো
আর ছিলো রুপালি জোয়ার
স্বপ্ন ছিলো দিন রচনার।

সেই সব স্বপ্নের বলাকা
মেলেছিল পাখা,
মনের দিগন্ত ছেড়ে কোনো এক দিগন্তের পানে
কোনো দুর বন্দর সন্ধানে।

এখানে সমুদ্র ছিলো
ছায়া ছিল দুর বনানীর।
কোন এক আরণ্য রাত্রির
তীর ঘেষে কারা এসেছিলো
বন্যার আবেগ নিয়ে কারা যেন ভালোবেসেছিলো।

তারা আসে তারা ভালোবাসে,
তারা এসে রেখে যায় আমাদের জানালার পাশে
কোনো এক নতুন নিখিল,
অসংখ্য স্বপ্নের কুচি মুঠিমুঠি নীল।

সেই সব স্বপ্ন
যারা আকাশের নীলের মতন।
মুঠোয় জড়াতে চায় সেই নীল আমাদের মন।
আজ তারা নেই ।
তারা আসে তারা ভালোবাসে,
আজ শুধু মনে পড়ে
একদিন এসেছিলো কারা
উন্মুক্ত হৃদয়,
দিগন্ত উধাও এক পাখির চঞ্চল ডানা লয়ে।

আজ তারা নেই, আজ আছে
তাদের বিকৃত সুর হৃদয়ের আনাচে কানাচে।
আজ এই মন
আর আছে দুর্বিষহ অতীত স্মরণ।
ছিন্ন পালকের ছায়া দেখা দেয় কখনো আকাশে,
তার পাশে রৌদ্র-পীদ পৃথিবীর ঘাসে
বিকেলের সোনারাঙা পলাতক রোদেরা মিলায়
ভেঙে পড়া আকাশের গায়।
কাল যারা এসেছিলো তারা আজ স্বরন-নির্ভর।
আগামী দিনের যারা-
এই মৃত স্তুপের উপর
তারা যদি ঘর বাঁধে;
ভাঙা-চোরা দিনের ফাটলে
তারা যদি ভালোবেসে নতুন সূর্যের মত জ্বলে,
তাদের কি দেব হৃদয়?
সূর্য থেকে এ পৃথিবী
আরেক সূর্যের পানে বিস্তৃত কি নয়?

রেড্ রোডে রাত্রি শেষ

রাতের পাহাড় থেকে
খ’সে যাওয়া পাথরের মত
অন্ধকার ধ্বসে ধ্বসে পড়ছে।
দু’হাতে সরিয়ে তাকে নির্বিকার নিরুত্তাপ মন
এগোলো।

দু’পাশের পায়ে-চলা পথে
এখনো ঘুমের স্রোত মরেনি,
প’ড়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে
এখানে-ওখানে।
তারায় ভরা আকাশকে কাঁপিয়ে
শাদা কাফনের সঙ্কেত।

পদক্ষেপ জোরালো।
মনের সাথে নেই তার মিতালী,
অলস মন
ঘুমঘুম চোখের মত চাইছে
ছুঁয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে,
অথচ নেই অনাবশ্যক প্রখরতা-
আশ্চর্য!

খানিকটা হেঁটে গিয়ে
মার্কুইস লেন ছাড়িয়ে
কিড্ স্ট্রীট পেরিয়ে
             তারপর চৌরিঙ্গি।
গড়ের মাঠ দু’টুকরো
মাঝখানে আড়াআড়ি পীচের পথ
পেরিয়ে
    অতঃপর দীর্ঘ রেড্ রোড।

এখানে এই বিশাল পথ জড়িয়ে
অন্ধকার প’ড়ে আছে
দীর্ঘকায় সাপের মত।
আর আছে রেড্ রোডের দু’পাশে
তীক্ষ্ম চোখ জ্বালিয়ে
অন্ধকার শয়তানের পাহারা
                      তারা এখন মুমূর্ষু।

বাঁ-পাশের পাথরেগড়া মূর্তির গা বেয়ে
শেষরাতের শিশির এখনো ঝ’রছে
তার সাথে গ’লে গ’লে পড়ছে
অথবা পড়ছে ব’লে মনে হচ্ছে
এতদিনের যত্নে গড়া চেহারা-
তার ফাটলে বুঝি শেষ রাত্রির কান্না।

এদিকে আকাশে
কার শিকারী চোখের ছায়া জাগলো
কয়েকটি রেখা এসে লাগলো
দৈত্যকায় অজগরের পাঁজরে
তার দেহে লাগলো মৃত্যুর মোচড়।
এখন সাপের দেহ নড়বে
তারপর আকাশ থেকে ঝরবে
তীক্ষ্ণ তীর্যক বর্শা-
আর উড়বে অনেক দূরে
ছিন্ন ভিন্ন কালো সাপের দেহাংশ,
মিলিয়ে যাবে
রেড্ রোডের বুক থেকে,
এগিয়ে যাবে কেল্লার মাঠ পেরিয়ে
তারপর আরো এগোবে।
গঙ্গার গভীর জলে ঘুচবে কি তার লজ্জা!
অথবা ঘাটে বাঁধা অনেক দূরের জাহাজ,
যারা পার ক’রে দেয় পলাতক অন্ধকারকে
নিরাপত্তার পাল তুলে!

এরা সেই আপনি গড়া খেয়া নৌকোয় হয়ত-
পেরিয়ে যাবে গঙ্গা
মিলিয়ে যাবে পশ্চিম সীমান্তে,
নদীর জলে ঝলকে উঠবে মুক্তি,
বন্যা আসবে রেড্ রোডের প্রান্তে
কেননা
এদিকে আবার জাগবে নতুন সূর্য।

খানিকটা স্থির হ’য়ে সে থাকবে
তারপরে সে চম্কাবে
কাঁপবে
কেঁপে কেঁপে উঠে আসবে উপরে
ঝরাবে তার সোনা
ছড়াবে এই এখানে
এই রেড রোডের মরচে ধরা ঘাসে।
সকাল বেলার হাওয়ায় লাগবে জোর
পুরনো ধুলোরা এবার উড়বে।

একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ

এই ত এখানে সেই পুরনো নদীটি
এই সেই মধুমতী -মাঠ।
এখানে সবুজ ঘাসে
ঘুম আর ঘুম
ছিল এককালে।
কোনো একদিন
এ তীরে হলুদ ফুল ফুটেছে অশেষ,
সমুখে আমের বীথি এখনো রয়েছে;
ঘুঘুর অশ্রান্ত ডাক নেই।
নেই সেই ঘুম আজ
নেই সেই ঘাসের গালিচা,
ধূসর মাটির বুকে ধরেছে ফাটল।

ছ’বছর ছ’বছর নয়।
সহস্র বছর যেন ঝড় বয়ে গেছে।

যেখানে ছিলো ঘুমের ছায়া দোলানো
যেখানে ছিলো স্বপন মন-ভোলানো
সেখানে এসে দুরের কোনো ডানা
দস্যুসম দিয়েছে কবে হানা

এই নদী পিছে রেখে খানিক এগিয়ে
পার হয়ে এই মাঠ
আরো কিছু হেঁটে যেতে হবে
তারপর
এই ত এখানে।

এখানে আকাশ-ছোঁয়া
এইসব মাটির সীমানা
ঘেরা ছিলো বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে।
এখানে অজস্র সোনা ছিলো
আজও আছে।
মালিকানা হয়েছে বদল
যদিও সোনার-
যায়নি খনির বুকে ঘাম ঝরাবার অধিকার।
   
এখানে আছে সবুজ মাঠ সোনালি ধান
নেইকো শুধু সহজ দিন সবল প্রাণ
সোনার শীষে মরণজয়ী আশা
নেইকো বেঁচে মাটির বুকে নেই সে ভালোবাসা

এই মাঠে পথ আছে
চারদিকে ছড়ানো সে পথ।
দু’পাশে ধানের গাছ ভেঙে দিয়ে দিয়ে
সেই পথে চ’লে এসে-
এই ত পেয়েছি।

ঐ যে দীঘির পাশে ঐ ছোট একচালা ঘর
ঐ ঘরে বাস করে কাজেম বয়াতী
শুনেছি মরেনি আজো
যদিও মরেছে
সেই কন্ঠ তার-
চব্বিশ বছর ধ’রে যে কন্ঠের সুর,
রাতের গভীরে নিত্য তুলেছে জোয়ার
ঘরে ঘরে।

           কোথা সে দিন ভাবনাহীন ভয়বিহীন
           সুরের ছায়া ছড়ায় ঘুম কোথা সে দিন
           দিন কোথায়
           কোথা সে প্রাণ প্রাণের সেই বীণ কোথায়

ঐযে টিনের ছাওয়া আটচালা ঘর
দফাদার বাড়ি।
ও বাড়ির বিরাট ঊঠানে
বিরাট জামাতে এসে দেখা দিয়ে যেত
‘ছয়ফলমুলুক’ আর ‘বদিউজ্জামাল’
                                  বহু রাতে।
সে উঠান আজকে নীরব!

ঐযে ওধারে
খালের কিনার ঘেঁষে
         ঘরখানা ভেঙে পড়ে আছে
ওখানে মক্তব ছিলো।
মক্তবের ছেলেরা এখন
শহরে ইজের পরে
           কাঁটা আর চামচ সাজায়।

অজানা আঘাত ভেঙেছে ঘর
ভেদাভেদ নেই আপন-পর
বনের পাখিরা আজ খাঁচায়
মাথা বেঁচে দিয়ে প্রাণ বাঁচায়

এই সেই গ্রাম।
তবু যেন সেই গ্রাম নয়।
পঁচিশ বছর ধরে চেনা সেই গ্রাম
ঢেকে গেছে স্টবিয়াই নগরীর মত।

রাতের বাতাসে আজ
কাঁপে না বাঁশীর ভাটিয়ালী।
নারিকেল সুপারীর বনে
অন্ধকার থম থম করে,

শূন্য মাঠ,
চলে না পথিক,
প্রেতের ডানার তলে,
দু:স্বপ্নে দীর্ঘ রাত কাটে।

এই সেই গ্রাম।
এখানে নয়ন মেলে,
পা রেখে এখানে
আজ শুধু ভয় করে ওঠে।

যে আকাশ ছিলো হাতের মুঠায় জড়ানো
সে-আকাশে জাগে ভয়
মৌমাছি-ডানা-ঘুম দিয়ে দিন গড়ানো
সেদিন এখন নয়

এ মানুষ চলে যেন মৃতের মিছিল
সাড়া নেই কোনো।
সবার সমুখে
অলক্ষ্য উদ্ধত মুঠি জেগে আছে যেন।

ভয়ে ভয়ে একান্ত গোপনে
দিনান্তে ঘরের কোণে তারা
অন্ধকারে করে অনুভব
বেঁচে আছে আজো।

অনেক মানুষ ছিলো মরেছে অনেক।
সেই সাথে মরে গেছে তারো চেয়ে বেশি-
শতাব্দীর গ’ড়ে ওঠা এইসব গ্রাম।

থাকো মধ্যম সারিতে

এ্যরেনা তোলপাড়
দেখো তুমুল লড়াই চলছে
চতুর্দিকে তীক্ষ্ণ শিং-এ বিদ্যুৎঝলক।
মধ্যমঞ্চে হতবাক তুমি এক অস্থির পুরুষ। তুমি
দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য
কেবলি পালাতে চাও
        কোথায় পালাবে ?

থাকো মধ্যম সারিতে তুমি
সামনে চোখ
পেছনে প্রবল থাবা টেনে নেয় প্রচণ্ড আক্রোশে
বারম্বার সামনে নামে ধস্।
দিনরাত্রি টানাপোড়েনের খেলনা
আছো তুমি স্বনির্মিত খাঁচার কবলে।

তোমার চারপাশে খুন রাহাজানি
দেখো তীব্র রক্তস্রোত ধাবমান তোমার পশ্চাতে।
দাবাগ্নির মত জ্বলে নিরন্নতা
নগ্নতা বাজায় ডঙ্কা
চতুর্দিকে আদিম নিনাদ, দেখো
ত্রিভূবন কাঁপে। তুমি
অস্থির খাঁচার দাঁড়ে বারম্বার স্থির হতে চাও
চতুর্দিকে অস্থিরতা বাড়ে।

মধ্যম সারিতে থাকো
সামনে চোখ প্রথম সারিতে
তোমার দু’ বাহু ছুঁয়ে ঝুলে আছে একপাল ক্ষুধা,
পৃথিবীর প্রথম চীৎকার
তীক্ষ্ণ বল্লমের মত ছুঁয়ে আছে তোমার পৃথুল পৃষ্ঠদেশ।

অদৃশ্য মেলায় থাকো
সারি সারি তুমুল উজ্জ্বল প্রদর্শনী
নৃত্যপর দু’চোখে। হঠাৎ
শীর্ণ সারিসারি হাত অগ্নিগোলকের মত
ছুটে আসে তোমার চারপাশে, তুমি
ক্ষিপ্র হাতে যতই দূরদূর করো
নৈকট্য ক্রমশ বাড়ে
অগ্নিগোলকের থাবা ব্যাপ্ত হয় মেলার তাঁবুতে।
তুমি যতই সাবধানে দাও হামাগুড়ি, তুমি
যতই সন্তর্পণে পা রাখো মসৃণ পথে
কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথের তীক্ষ্ণ কামড় দু’পাশে, তুমি
এড়াবে কি ক’রে?

বালক-স্বভাবে তুমি যতই পাঁচিল তোলো দেখো
নোংরা কাঁথা ভাঙা হাঁড়ি
দগদগে ঘায়ের নীচে দেখো পোড়া মানুষের চাপ

তুমি কোন পথে নিমন্ত্রণে যাবে?

সার্চ

‘হল্ট’ বলে হুঙ্কার ছেড়েই যম সামনে খাড়া।

লোমস কর্কশ হাত ঢুকে গেলো প্যান্টের পকেটে...
কিছু পয়সা দুটি ফুল সুতোর বান্ডিল
            অতঃপর
ভারী হাতে কোমর জরীপ। কিছু নেই।

কুছ নেহি ? বোমাওমা? সাচ্ সাচ্ বাতাও, নেহিত...

         দেখুন দেখুন
নিজেই নিজের হাতে শার্টের প্যান্টের সব পকেট ওল্টায়
        বলে দেখুন দেখুন।

 ছেলেটির পাতলা ঠোঁটে হাসির প্রলেপ না কি?
চাপা কিছু কৌতুক ? আহারে
সরল কিশোর,
তার হয়তবা চেনা নেই
        মৃত্যুর চেহারা!

‘যাও’ বলে আবার গর্জন আর ছেলেটি অটল
ধীর পায়ে চলে গেলো
    আপন গন্তব্যে
তার গন্তব্য কোথায় ?
তার গন্তব্য কোথায় ? তার ভয় নেই ?

ভয় নেই। দুর্জনের হাত
বারবার পকেট ওল্টাবে
        রাখবে কোমরে দানব থাবা অতঃপর
অক্ষম আক্রোশে গর্জাবে এবং
        ফিরে যাবে দুর্বোধ্য তিমিরে।
        ফিরে যাবে
 কেননা ছেলেটি
 সেই কিশোর সৈনিক
 সেই দেবশ্রী কিশোর
রাখেনি তেমন কোনো অস্ত্র সঙ্গে। তার
বুকের গভীরে
মহত্তম সেই অস্ত্র যার
দানবের স্পর্শযোগ্য অবয়ব নেই কোনো
ধ্বনি যার অহরহ প্রাণে তার বাজায় দুন্দুভি:
স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা!

আর সেই প্রিয়তম মহত্তম অস্ত্র বুকে
লুকিয়ে সন্তর্পণে ধীর পায়ে
অনন্য কিশোর তার
        সঠিক গন্তব্যে যায় হেঁটে।

সেই অস্ত্র


আমাকে সেই অস্ত্র ফিরিয়ে দাও
সভ্যতার সেই প্রতিশ্রুতি
সেই অমোঘ অনন্য অস্ত্র
        আমাকে ফিরিয়ে দাও।

 সেই অস্ত্র আমাকে ফিরিয়ে দাও
 যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
পৃথিবীর যাবতীয় অস্ত্র হবে আনত
 যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
     অরণ্য হবে আরো সবুজ
    নদী আরো কল্লোলিত
        পাখিরা নীড়ে ঘুমোবে।

যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
ফসলের মাঠে আগুণ জ্বলবে না
        খাঁ খাঁ করবে না গৃহস্থালি।

সেই অস্ত্র আমাকে ফিরিয়ে দাও
যে অস্ত্র ব্যাপ্ত হলে
নক্ষত্রখচিত আকাশ থেকে আগুণ ঝরবে না
মানব বসতির বুকে
মুহূর্তের অগ্নুৎপাত
লক্ষ লক্ষ মানুষকে করবেনা পঙ্গু-বিকৃত
আমাদের চেতনা জুড়ে তারা করবে না আর্তনাদ
সেই অস্ত্র যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
বার বার বিধ্বস্ত হবে না ট্রয়নগরী।

আমি সেই অবিনাশী অস্ত্রের প্রত্যাশী
যে ঘৃণা বিদ্বেষ অহংকার
    এবং জাত্যাভিমানকে করে বার বার পরাজিত।

যে অস্ত্র আধিপত্যের লোভকে করে নিশ্চিহ্ন
যে অস্ত্র মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে না
            করে সমাবিষ্ট

সেই অমোঘ অস্ত্র-ভালোবাসা
পৃথিবীতে ব্যাপ্ত করো।



রে কিশোর


 কে বলে জন্মান্ধ তুই
         তোরও দুই চোখে
    ছিলো আলো
স্বর্গের অমল জ্যোতি ছিলো।

 চোখ মেলে তুইও অনায়াসে
        আজীবন নীলাকাশ
    বনভূমি
        রুপালি নদীর স্রোত
মনোরম অন্ধকার রাতের জোনাকি
         দেখে যেতে যেতে
জন্মের সমস্ত ঋণ শুধে যাবি
        এই কথা ছিল।

অস্থানে ভূমিষ্ট তুই
        পৃথিবীর আলো
             তোকে স্পর্শ করার আগেই
         তোর চোখে বানানো আন্ধার
তীক্ষ্ণ বল্লমের মত ছুঁড়ে দিয়েছিল যে দুর্জন
            আমি তাকে চিনি।
না তুই জন্মান্ধ ন’স
            বানোয়াট অন্ধতার বেড়া
            এই ভ্রান্তি
        ভুলে যা ভুলে যা
বুকের আগুনে ক্লান্ত করতল
             নে জ্বালিয়ে নে রে
জ্বলন্ত আঙুলে
 বিদ্ধ কর দুই চোখ
    দৃষ্টি ফিরে পাবি, তুই
        মাথা তুলে দাঁড়া
দে তোর অমল দৃষ্টি মেলে দে ভুবনে।

 দেখে নে শ্যামল বিভা বনানীর
        বনরাজীনীলা
            এই পৃথ্বী
নদী
নারী
শস্যমাঠ চিনে নে, এবং
        তারো আগে শত্রু শিবির।

সারা দিন আমি


বুকের মধ্যে সারা সকাল কি যে অকাল বৃষ্টি ঝরে
             রোজ সকালে।
রোজ সকালে রোদপোয়ানো ভঙ্গি থাকে শিরীষ ডালে।
এই আলো এই বৃষ্টিপতন মাঝখানে তার এই জানালা
ত্রস্ত হাতে বাতাস থেকে ধুলো ঝাড়ার ব্যস্ত পালা।
সারাটা দিন ধুলো ঝাড়ার এই পালা নয় সাঙ্গ হবার,
ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে যাবো বুকের মধ্যে রক্তজবার।

মননে নৈকট্যে এলে উড়তে থাকে ফুলের মাছি।
এই ফুলে এই মাছির গায়ে মাছির মতই লেপ্টে আছি।
ফুলের আতর ধুলোয় মেশে রোদ জ্বলে আর বৃষ্টি ঝরে
বাইরে আলো ফুলের রেণু আমার বৃষ্টি আমার ঘরে।

কেউ বলে তুই দু'চোখ মেলে পদ্মপত্রে দেখলিনে জল,
এই যে এত বৃষ্টিপতন রক্তক্ষরণ তবু অটল
রইলি বসে, দেখলিনে এই ধুলোর মধ্যে বাসা রোগের,
জানলিনে এই সারাটা দিন ধুলোর সঙ্গ কি দুর্ভোগের।
কেউ বলে অরণ্যচারী পশুর চোখেই শুদ্ধ আলো
আমার কিন্তু ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে যাওয়াই লাগছে ভালো।

ঝরা পলাশ


এই নিয়ে বারবার নতুন দিনের বাসনায়
বেঁধেছি অনেক বাসা মৃত্যুমুখী দিনের সীমায়।
এবার আবার সেই দিন !
সেই ঝরা পলাশের দিন !
তবুও মাটিতে জাগে মৃদুগন্ধ কামনার ভার
তাই নিয়ে হৃদয়ের অসহ্য প্রয়াস বার বার
বাসা বাঁধবার !
সেই বাসা ঝড়ে উড়ে যায়
সেই বাসা মাটিতে মিলায়
পৃথিবীর জনারণ্যে জনতার দুর্বিনীত পায়;
নির্লজ্জ হৃদয়ে তবু ছায়া ফেলে বাসনার সোনা
নতুন বাসার আশা তবু চিত্তে করে আনাগোনা
তার চেয়ে এই ভাল নয়
হে মোর হৃদয়?

যে পলাশ ঝরে গেছে আজ তার প্রতিটি পল্লব
শাণিত খড়গের মত হানে যদি বাসনার শব
অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস ছিন্ন করে যদি নেয় ভার
ইস্পাত-কঠিন এক দিন রচনার-
সে কি ভালো নয়,
হে হৃদয়, হে মোর হৃদয়?

হে বাঁশরী অসি হও


হে বাঁশরী অসি হও তুমি!
কেন না দুর্গের দ্বারে হানা দিল হায়েনা নয়ন;
কেন না উদ্যত আজ শাণিত নখর বহু
            শিবিরের উলঙ্গ আকাশে-
অতএব হে বাঁশী
        অসি হও তুমি;
অসি হও এ মোর প্রার্থনা !

মুমূর্ষু মাটির বুকে ভেঙেছে রাতের বহু নীড়,
লেলিহ তির্যক ফণা ছুঁয়েছে সহজ দিনগুলি;
শীতল চোখের পাশে
কালো  ডানা ছায়া ফেলিয়াছে;
অতএব হে বাঁশরী
        অসি হও অসি হও তুমি!

সুরের পেলব কুঁড়ি পেছনে উড়াও;
এবার দিনের চূড়া আকাশে ঘুরাও।
অরণ্য-স্বপন নয়
        এবার আরণ্য প্রতিরোধ;
নির্বিরোধ গুহাতলে
        অহিংসার গৌরব নিঃশেষ
বহুকাল-
এবার সূর্যের মুখোমুখি
স্বাক্ষরিত হোক তব সৈনাপত্য অঙ্গীকার-লিপি!
এবার প্রান্তর আর ধূলিম্লান পথ ডাকিতেছে,
এবার নীরব থাকা বাতায়নে বলয়বন্ধন;
এবার বন্যার মত আঁখিজল আনুক বিদ্রোহ।
আসন্ন মৃত্যুর মুখে অগ্নিময় ঝলসি উঠুক
বাঁচিবার পণ!

হে বাঁশরী অসি হও তুমি!
কেন না গৃহের দ্বারে অহিংস বৌদ্ধের তরবারি
মৃত্তিকার পিপাসায় জ্বলে!
(যদিও হাওয়ার দূত বহে আজো প্রীতি ও প্রত্যয়
ক'রো না প্রত্যয়,
পদ্মের ছলনাতলে জেগে আছে কেউটের কুণ্ডল!)
অতএব হে বাঁশরী অসি হও তুমি !
অসি হও এ মোর প্রার্থনা!

দিনগুলি মোর


দিনগুলি মোর বিকলপক্ষ পাখির মতো  
বন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণ্যমান।                                                

আকাশে আজিও কামনার শিখা উজ্জ্বল কমনীয়।
জ্বলে দিগন্তে দীপ্ত দিবার দীপগুলি রমণীয়।
আমার নয়নে নেমেছে রাত্রি পঙ্গুতার
অন্ধকারের গুহাতে ব্যর্থ বাহুবিথার।

মনের ফাটলে স্মরণাশ্রিত স্বপ্নের কণাগুলি
জন্ম দিয়েছে লক্ষ বীজাণু কুটিল মৃত্যুদূত।
নীল অরণ্যে এল অপঘাত অকস্মাৎ
যুগের চিতায় জ্বলে জীবনের প্রিয় প্রভাত।
অন্ধ নয়নে দিনের কামনা আজিও ঊর্ধ্বায়িত
মনের অশ্ব  হ্রস্ব চরণ বঞ্চনা-বিক্ষত।

দিনগুলি আজ জরতী রাতের দুঃস্বপন,
চির দহনের তিক্ত শপথ করে বহন!
দিনগুলি মোর শ্বাপদ-বিজয়ী অরণ্যেতে
শর-খাওয়া এক হরিণ-শিশুর আর্তনাদ।

সে নেই

এখনো ভোরের রোদে সোনা ঝরে-
কুড়িয়ে নেবার
কিশোর ছেলেটি নেই।

শীতের সকালে
নিঃশেষ শিউলির ডাল,
বোশেখে বকুল
নাম ধরে ডাক দেয় ;
সাড়া নেই।
যার
নিজের খুশীতে রাত ভোর হতো
কাকভোরে তার
এখন ভাঙে না ঘুম।
সকালের সোনা
অকারণে ছুঁয়ে ছেনে সাগরজোয়ার
জাগাবার কেউ নেই,
কেউ নেই তাকিয়ে দেখার
চোখ মেলে।
এখনো ভোরের রোদে
দুটি কি তিনটি হরিয়াল
ঘুম ঝাড়ে শিরিষের ডালে,
সুর তোলে,
সে সুর শোনার কেউ নেই
জেগে নেই কিশোর ছেলেটি।
এখন ছেলেটি
সারাদিন ভয়ের ভাবনার
পথে হেঁটে ;
এখানে-ওখানে হাত পেতে
মিনতি জানায় :
গান নাও
সুর নাও
ফুল পাখি চাঁদ নাও
সমস্ত ভোরের সোনা এই নাও।
শুধু দাও-
একটু নির্ভর
আর
একটু ভরসা দাও মনে ;
একটু আশ্বাস দাও বেঁচে থাকবার
মাথা রাখবার ঠাঁই দাও।

সারাদিন পথে হেঁটে
সারাদিন মিনতি জানিয়ে
 শুধু তার মিনতির
প্রতিধ্বনি কুড়িয়ে কুড়িয়ে
দিন গেলে ;
কখন পথের পাশে ঘুমায় ছেলেটি।
পাশে তার
‘তিরিশ বৎসর কাল’
ক্লান্ত হয়ে ঘুমায় এখন।
কিশোর-চোখের সেই দৃষ্টির লাবণি
অসহ্য ঘুমের স্রোতে
ভেসে যায়। পৃথিবী যদিও
        চিরযৌবনা তবুও
সেই ভোরে
তাকিয়ে দেখার
          কেউ নেই
         জেগে নেই-
যদিও এখনো
ফুল ফোটে পাখি গায়
        আর
এখনো ভোরের রোদে সোনা ঝরে;
ঝরেছে যেমন
হাজার বছর ধ'রে পৃথিবীতে।

আমি কোন আগন্তুক নই : আহসান হাবীব

আসমানের তারা সাক্ষী
           সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পুবের পুকুর, তার ঝাঁকড়া ডুমুরের ডালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
            আমি কোন অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি কোন ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোন আগন্তুক নই।
আমি কোন আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
          এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা-
                        সারা দেশে। 

আমি কোন আগন্তুক নই। এই
খররৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
           তারা জানে আমি কোন অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
           সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা         
              নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
                তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চির চেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
               সে আমাকে চেনে।
হাত রাখো বৈঠায় লাঙলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
             লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোন আগন্তুক নই।

দু’পাশে ধানের ক্ষেত
          সরু পথ
              সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
               মুগ্ধ এক অবোধ বালক।