বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১১

নিষ্ফল কামনা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবি অস্ত যায়।

অরণ্যেতে অন্ধকার, আকাশেতে আলো।

সন্ধ্যা নত-আঁখি

ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে।

বহে কি না বহে

বিদায়বিষাদশ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস।


দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে

চেয়ে আছি দুটি আঁখি-মাঝে।

খুঁজিতেছি, কোথা তুমি,

কোথা তুমি।

যে অমৃত লুকানো তোমায়

সে কোথায়।


অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে

বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন

স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,

ওই নয়নের

নিবিড় তিমির তলে, কাঁপিছে তেমনি

আত্মার রহস্য-শিখা।

তাই চেয়ে আছি।

প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবিতেছি

অতল আকাঙক্ষা-পারাবারে।


তোমার আঁখির মাঝে,

হাসির আড়ালে,

বচনের সুধাস্রোতে,

তোমার বদনব্যাপী

করুণ শান্তির তলে

তোমারে কোথায় পাব--

তাই এ ক্রন্দন।


বৃথা এ ক্রন্দন।

হায় রে দুরাশা,

এ রহস্য এ আনন্দ তোর তরে নয়।

যাহা পাস তাই ভালো,

হাসিটুকু, কথাটুকু,

নয়নের দৃষ্টিটুকু,

প্রেমের আভাস।

সমগ্র মানব তুই পেতে চাস,

এ কী দুঃসাহস!

কী আছে বা তোর,

কী পারিবি দিতে?

আছে কি অনন্ত প্রেম?

পারিবি মিটাতে

জীবনের অনন্ত অভাব?


মহাকাশ-ভরা

এ অসীম জগৎ-জনতা,

এ নিবিড় আলো অন্ধকার,

কোটি ছায়াপথ, মায়াপথ,

দুর্গম উদয়-অস্তাচল,

এরি মাঝে পথ করি

পারিবি কি নিয়ে যেতে

চিরসহচরে

চিররাত্রিদিন

একা অসহায়?


যে জন আপনি ভীত, কাতর, দুর্বল,

ম্লান, ক্ষুধাতৃষাতুর, অন্ধ, দিশাহারা,

আপন হৃদয়ভারে পীড়িত জর্জর,

সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন-তরে?

ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব,

কেহ নহে তোমার আমার।

অতি সযতনে,

অতি সংগোপনে,

সুখে দুঃখে, নিশীথে দিবসে,

বিপদে সম্পদে,

জীবনে মরণে,

শত ঋতু-আবর্তনে

শতদল উঠিতেছে ফুটি;

সুতীক্ষ্ণ বাসনা-ছুরি দিয়ে

তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে?


লও তার মধুর সৌরভ,

দেখো তার সৌন্দর্য-বিকাশ,

মধু তার করো তুমি পান,

ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী,

চেয়ো না তাহারে

আকাঙক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।


শান্ত সন্ধ্যা, স্তব্ধ কোলাহল।

নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে,

চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।

পৃথিবী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী,

শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।


মহাবীর্যবতী, তুমি বীরভোগ্যা,

বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,

মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে;

মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্দ্বে।

ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা

বাম হাতে পূর্ণ কর পাত্র,

তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে;

দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎজীবনে যার অধিকার।

শ্রেয়কে কর দুর্মূল্য,

কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।

তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছ প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম,

ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক।

জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি,

সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।

তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ,

ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে।


তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের প্রতাপ ছিল দুর্জয়,

সে পরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়।

তার অঙ্গুলি ছিল স্থূল, কলাকৌশলবর্জিত;

গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত;

অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে।

জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি,

প্রাণের 'পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা।


দেবতা এলেন পরযুগে--

মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের,

জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;

জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।

উষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,

পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট।


নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব,

তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।

ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা,

তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে

হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে।

তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি।

দেবতার মন্ত্র উঠছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে

দিনে রাত্রে

উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে।

তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব

ক্ষণে ক্ষণে উঠছে ফণা তুলে,

তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করছ আঘাত,

ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে।


শুভে অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে,

তোমার প্রচণ্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে

আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত জীবনের প্রণতি।

বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর গুপ্তসঞ্চার

তোমার যে মাটির তলায়

তাকে আজ স্পর্শ করি, উপলব্ধি করি সর্ব দেহে মনে।

অগণিত যুগযুগান্তরের

অসংখ্য মানুষের লুপ্ত দেহ পুঞ্জিত তার ধুলায়।

আমিও রেখে যাব কয় মুষ্টি ধূলি

আমার সমস্ত সুখদুঃখের শেষ পরিণাম--

রেখে যাব এই নামগ্রাসী,আকারগ্রাসী,সকল-পরিচয়-গ্রাসী

নিঃশব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।


অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলোকে উধাও পৃথিবী,

গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যানমগ্না পৃথিবী,

নীলাম্বুরাশির অতন্দ্রতরঙ্গে কলমন্দ্রমুখরা পৃথিবী,

অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তা তুমি ভীষণা।

এক দিকে আপক্কধান্যভারনম্র তোমার শস্যক্ষেত্র,

সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু

কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে।

অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী--

"আমি আনন্দিত'।

অন্য দিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্রে

পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য।

বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল

কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়,

সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ,

তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু ক'রে

হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে।

হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল

শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো।

আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিনে হাওয়া

ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ

আম্রমুকুলের গন্ধে।

চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে

স্বর্গীয় মদের ফেনা।

বনের মর্মরধ্বনি ঝঞ্ঝাবায়ুর স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে

অকস্মাৎ কল্লোচ্ছ্বাসে।


স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী, তুমি নিত্যনবীনা,

অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে

সংখ্যাগণনার অতীত প্রত্যুষে,

তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ

শতশত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ--

বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তোমার বর্জিত সৃষ্টি

অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে।


জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ

তোমার খণ্ডকালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে।

তারই মধ্যে সব খেলার সীমা,

সব কীর্তির অবসান।


আজ আমি কোনো মোহ নিয়ে আসি নি তোমার সম্মুখে,

এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে

তার জন্যে অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে।

তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে

যে বিপুল নিমেষগুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে

তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো একটি আসনের

সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি,

জীবনের কোনো একটি ফলবান খণ্ডকে

যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে

তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে;

সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে

যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।

হে উদাসীন পৃথিবী,

আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে

তোমার নির্মম পদপ্রান্তে

আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।

রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১১

বাতাসে লাশের গন্ধ -রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরেৃ
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?


বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ -
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়

এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমুতে পারিনা-

রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন -
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো - নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: " কখন আসবে কবি?'

এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ ... ।

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, -- এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে।

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: "কখন আসবে কবি?' "কখন আসবে কবি?'

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

বারবারা বিডলার-কে -আসাদ চৌধুরী


বারবারা
ভিয়েতনামের ওপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়

আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।
আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে কি চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয় ?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে।

আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ

বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।


টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল-
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠতেন।

অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো-
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্যে
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়ো না-
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।
বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে ধ্বংস করার পূর্বে
ছাত্রপত্রহীন সূর্য কিরণকে বিষাক্ত করার পূর্বে
এসো বারবারা, বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।

ছবি - আবু হেনা মোস্তফা কামাল

আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোন মনোহারী স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না - আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে-পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টার্লিঙের বিনিময়ে যা পাবেন
ডাল্লাস অথবা মেম্ফিস অথবা কালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ!

আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোন শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল
নয় কি ?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ
অকৃত্রিম;
আপনাকে আরো খুলে বলি : এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।

খাঁটি আর্যবংশসম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ নটি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা -কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন ?
ভ্যানগগ্ - যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালী তুলে এনে
ব্যবহার করতেন- কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দেখেন নি!

আর দেখুন, এই যে নরমুন্ডের ক্রমাগত ব্যবহার-ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে- আসলে ওটাই এই ছবির-অর্থাৎ
এই ছবির মতো দেশের -থিম্ !

সঙ্গতি - শহীদ কাদরী

(অমিয় চক্রবর্তী, শ্রদ্ধাস্পদেষু)


বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...

একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...

ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের- তোমরা দু'জন একঘরে পাবে ঠাঁই

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...