রবিবার, ৩ জুন, ২০১২

হে আকাশ হে অরণ্য - আহসান হাবীব

হে আকাশ হে অরণ্য
তোমাদের মাঝখানে কতবার কত না প্রাচীর
বেঁধেছে হৃদয়;
তবু বারবার সমুদ্রের তীর
সহসা তরঙ্গ হানে
ছুঁয়ে যায় আকাশের কোণ,
আবার সে পুরনো স্বপন
ভাঙে সে প্রাচীর আর জাগায় বিস্ময়,
আবার সমুদ্রতীরে সেই ঝড় বয়।
সেই ঝড় দোলা দেয় অশোকের বনে!
সেই ঝড় ঝড় আনে গগন-গহনে!

সেই সব রাত আর সেই সব তারারা আবার
হাজার হাজার যুগ হ’য়ে যায় পার,
সেই সব পরীদের চোখ
আবার উজ্জ্বল হয়,
ঝরোকায় নতুন আলোক।
বিবসনা শা’জাদী ঘুমায়-
মনের কিনার ঘিরে সেইসব ঘোড়াদের পায়
পাহাড়ের তট ভাঙে
আর ভাঙে হৃদয়ের তীর,
আবার উধাও পাখা সেই সব পুরনো পাখির।
তারপর হে আকাশ হে অরণ্য
আবার বিরোধ,
আবার সীমান্ত ঘিরে সেই প্রতিরোধ
অরণ্যে আকাশে,
সমুদ্রের কালো জলে দিনগুলি ফেনা হ’য়ে ভাসে।
ভেসে যায় অরণ্য-কিনার।
খসে পড়ে সেই গ্রন্থি
ধ'সে পড়ে মনের মিনার।

তার চেয়ে হে আকাশ হে অরণ্য
সেইসব দিনের ছায়ারা
সেইসব মমীদের মলিন কায়ারা
এখানে ঘুমাক।
আমার হৃদয় থেকে সেইসব দিন মুছে যাক।
এখানে নামুক দিন
পাখা নেই যেসব দিনের,
এখানে নামুক রাত
যে রাতের ছায়াতলে স্বপ্ন নেই নীল কপোতের।
এখানে নামুক ছায়া
 যে ছায়ারা ঘর বেঁধে রয়,
এখানে নামুক ছায়া
যে ছায়ারা কায়াহীন নয়।

আজকের কবিতা - আহসান হাবীব

এখানে তোমার ছাউনি ফেলো না আজকে
     এটা বালুর চর:
চারদিকে এর কৌটিল্যের কন্টকময় বন ধূসর!
ঊর্ধ্বে আকাশ ম্লান মেঘের
নিম্নে অতল বন্যা এর-
বাস করে শত চানক্যশিশু শকুনির বহু বংশধর
এখানে তোমার ছাউনি ফেলো না এখানে বেঁধো না বিরাম ঘর।

পূবালী হাওয়ার নিশাস শুনছ?
             জ্বলবে না আজ গৃহের দীপ!
পায়ের তলায় শ্বাস ফেলে যায় হিংস্র কুটিল সরীসৃপ!
             বিংশ শতকী সভ্য দিন-
             শাণিত কৃপাণ শঙ্কাহীন
শস্যে হানবে শুনো ক্ষেতে তার হবে স্বার্থের হীন জরিপ
নীল রক্তের অভিশাপে ঘেরা জাগে নিপিষ্ট রিক্ত দ্বীপ।

তোমার আমার দিন ফুরায়েছে যুগটাই নাকি বৈপ্লবিক-
গানের পাখিরা নাম সই করে নীচে লিখে দেয় রাজনীতিক
            থাকতে কি চাও নির্বিরোধ?
           রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।
নীড় প্রলোভন নিরাপদ নয় বোমারু বিমান আকস্মিক
আরব্ধ গান এইখানে শেষ আজকে আহত সুরের পিক।

সপ্তসুরের উর্বশী তব আজি অথর্ব মৃত্তিকায়
কাঁদে মন্দার-গন্ধ-বিরহী বন্ধ্যাদিনের বন্দী বায়।
             ধুলায় ধূসর দীর্ঘ পথ
            হানছে কঠোর সুর শপথ
কল্প কামজ কুমারী কন্যা জ্বলে প্রচন্ড দিন শিখায়,
রমণীয় চাঁদ রাত্রির সুর মরেছে যাত্রা প্রান্তিকায়।

অদূর অতীত অখ্যাত দিনে যে সুর করেছে জন্মলাভ
সে জন্মপাপে আজকে জেগেছে আকুল আর্ত এই আবার
             হারানো সুরের কঙ্কালের
             দুঃসহ স্মৃতি তিক্ত জের
নির্বিকল্প কাল- প্রেক্ষায় আনে বিভ্রম বৈরিভাব,
অকাল-জন্ম ঋণ শোধ করে সৃজি সহস্র ঊর্ণনাভ।

আমাদের দিন মৃত্যু-তুহীন দীর্ঘায়ু হবে শ্যেনবিধান,
মৃৎ-পিপাসা ও শান্তিহরণ চিরদিন রবে বিদ্যমান।
          জঠরের জ্বালা চিরন্তন
          চির ক্লেদাক্ত এই জীবন
যুগ নিষাদের কপিশ নয়ন হানবে সেখানে দৃষ্টিবাণ।
আজকের দিনে এই ত কবিতা গানের পাখির এই ত গান।

আমি আছি - আহসান হাবীব

নক্ষত্র আঁধার আর এই ক্ষোভ হাহাস্বরে নেই
দক্ষিণ বাতাসে পাতা মন্দিরায় আমি নেই। আমি
প্রস্তরে ছিলাম। আমি ধাবমান প্রাচীণ হরিণ আর
      হিংস্র পশুর চোখে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ছিলাম, আমি
      নিয়ন্ত্রিত সাজানো আগুনে বৃত্তাকারে
      ছিলাম অপরাজেয় প্রতিদ্বন্দী স্মৃতিহরণের।

আমাকে পাবে না তুমি এই শুষ্ক তৃণদলে, তুমি
আমাকে পাবে না এই মৃত্তিকার গহ্বরে, কেননা
      আমি এই মৃত্যুকে লঙ্ঘন করি বারম্বার
      মৃত্যুকে লঙ্ঘন করে বহমান ইতিহাসে যাই
এবং নিজেকে আমি বারম্বার পার হয়ে ইতিহাসে লগ্ন হই
ব্যাপ্ত হই তোমাতে এবং তোমার স্বজনলোকে। আমি
তোমার অস্তিত্বে গাঁথা। খররৌদ্রে ঝড়ে ও বর্ষায়
আজন্ম তোমার সঙ্গী, আমি নই তুমিই আমার
প্রতিবিম্ব। আমি প্রস্তর অরণ্য আর ধাবমান হরিণের কাল
পার হয়ে অবিশ্রান্ত তোমাতে ধাবিত।

অরণ্য আমার নয়, নদী নয়, নক্ষত্রও নয়
তোমাকে দিয়েছি আমি আরণ্য অভীপ্সা আর দিয়েছি নদীর
প্রবহমানতা। এই ফুল নয়, পাখি নয়, চন্দ্রিমা আমার নয়, তবু
        ফুল আর পাখির উৎসব আমি দিয়েছি তোমাকে
               চন্দ্রিমার বিষাদ দিয়েছি।

আজন্ম তোমার সঙ্গী, স্বপ্নে আছি সংগ্রামেও আছি
আমি সঙ্গে থাকি তাই সঙ্গীত-সভায় বাজে করতালি
সঙ্গে থাকি সামনে থাকি তাই রুদ্ধ উৎসব তোরণ
                কেঁপে কেঁপে ওঠে।

ব্যাকুলতা আমাকে ছোঁবে না। আর্তিতে পাবে না।
তোমার ঘরেই দেখ কেমন বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ে আছি
        এবং আমার প্রতিদ্বন্দী তুমিই এ কথা
জেনে নিলে জানবে তুমি কে কোথায় আছি।

ফিরতে হবে - আহসান হাবীব

ফসল কুড়াতে হলে ফিরতে হবে এই পথে আসতেই হবে
মাছরাঙা বসিয়ে ডালে তুমি নীল মাছের আশায়
ইট কাঠ লোহা আর বারান্দার টবের উৎসবে
লীন হলে, জানবেই না কোথায় কখন চলে যায়
সাজানো নৌকার পাল, চলে যায় সারি গেয়ে দাড়ি
জানবে না কোথায় আছে তোমার আপন ঘাট আছে ঘরবাড়ি।

তোমার স্বজন আছে এই ব্যাপ্ত আদিগন্ত মাঠের মেলায়
ঘাটের কলসীতে আছে ঝলকিত পিপাসার জল
তুমি মেতে থাকলে দূর দ্বীপান্তরে নিঃসঙ্গ খেলায়
বেলা পড়ে যাবে। আর অবেলায় থাকে না ফসল।

ফসল তুলতে হলে ফিরতে হবে, এই পথে আসতেই হবে
অনেকেই জানতে চায় তুমি ঘরে ফিরে যাবে কবে,
জানতে চায় ঘরের মানুষ কেন বাইরে চলে যায়...
আমি কী উত্তর দেবো ? ওরা তবু আছে প্রতীক্ষায়!

যৌবনে জীবনে তুমি -আহসান হাবীব

তোমারই আভায় নিত্য নবরূপে তোমাকে দেখার
আকাংখার দীপ জ্বেলে হৃদয়ে
কৈশোর-যৌবনের সারাপথ হেঁটেছি,
জীবন আমার একার নয় জেনেছি
            এবং তোমাতেই সমর্পণ করেছি;
রেখেছি একাগ্র দৃষ্টির আলো পথে ফেলে
যে পথের ধুলি মেখেছি সর্বাঙ্গে
আর কারার নির্মম অন্ধকার উপেক্ষা করেছি
মুক্ত বুক সঙীনের মুখে পেতেছি নির্ভয়ে
শুধু এক অকৃত্রিম বাসনায়।
পলাশ বকুলে বিকশিত
সোঁদাল মাটির গন্ধে মর্মরিত
হলুদ ফুলের স্বচ্ছন্দ সহজ সমর্পণে
সজ্জিত চিত্রিত এক অকৃত্রিম প্রতিমার কামনায়
এ জীবন সমর্পিত ছিলো।

তোমাকে পেয়েছি অতঃপর অতি কাছে
বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে।
বহু রক্ত
    প্রিয়জন
        অতি প্রিয় জীবনের সব সুধা
        আর আনন্দের বিনিময়ে।
অথচ আশ্চর্য এই
জননীর সে মহিমা বিলিয়ে পুরনো সেই নাগরের পায়ে
নর্তকীর ভূমিকায় আজো তুমি
মগ্নচেতনার অন্ধকারে আবিষ্ট আত্মার বলি এক।

বলদর্পী  বণিকের মানদন্ড আনত।
তোমার সর্বাঙ্গে সে রেখে গেছে পীড়নের বহু ক্ষত
আরো জীবনের উদভ্রান্ত অশ্লীল বহু নিমিষের
ক্লান্ত মত্ততার জ্বালা।
সে জ্বালায় আজো তুমি জ্বলো!
তাই ঘরের সমস্ত মন দূরে বাইরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে
নিয়ত কাঞ্চনমূল্যে বেলোয়ারী  সম্ভারে
তোমার ঘর ভরে।
হৃততৃপ্তি আত্মার আবেগে কী মত্ততা!
আর সেই মত্ততার স্রোতে
কে নিত্য নতুন ঢেউ রেখে যায় জানো না

এবং তোমারই আভায় নিত্য নবরূপে তোমাকে দেখার
আমার আজন্ম তৃষা কেন কাঁদে তুমি তা জানো না।

কে নিত্য হরণ করে তোমার শ্যামল দেহলাবণ্য,
তোমার কুন্তলের কৃষ্ণাভা,
তোমার আত্মার উজ্জ্বল ভোর
কে নিত্য রঙিন মেঘে ঢেকে দেয়
            তুমি তা জানো না।

তুমি তা জানো না!
আমি জানি।
জানি তাই আকাঙ্খার দীপে
আত্মার সুধায় জ্বলে একটি শিখা অমর্ত্য আশায়
এবং প্রত্যহ
শিউলি কি বকুল কিম্বা পদ্মকলি ভোরের পাখিরা
যখন ডানার ঘুম ঝেড়ে আসে নিমন্ত্রণে
আমিও তখন
    তাকাই
তাকিয়ে দেখি একটি অমর আত্মা!
যদিও বিষণ্ন আর ভীরু
তবু অপার বিশ্বাসে তখন মিনতি রাখি আমিও
এবং বলি:
দেখো দেখো তোমার আত্মার অন্ধকারে
কে যেন হীরের কুচি ছড়িয়ে ছড়িয়ে
ডাকে শোনো!